পৃথিবীর সর্বাধিক জনপ্রিয় ও ব্যবহৃত কম্পিউটার ওএস বা অপারেটিং সিস্টেম হল উইন্ডোজ। টেক জায়ান্ট কোম্পানি উইন্ডোজ কয়েক দশক ধরে অপারেটিং সিস্টেম প্রস্তুত করে চলেছে। উইন্ডোজে আপডেটও আসে নিয়মিত এবং এর ব্যবহারবিধিও বেশ সহজ। তবে যে একটি বিষয়ে উইন্ডোজ বেশ পিছিয়ে আছে, সেটি হল সাইবারসিকিউরিটি। এই অপারেটিং সিস্টেমের সাথেই “উইন্ডোজ ডিফেন্ডার” নামক বিল্ট-ইন যে সফটওয়্যারটি আসে, আধুনিক সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তা অনেকক্ষেত্রেই তাল মিলিয়ে উঠতে পারে না। বিগত কয়েক বছরে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য আপডেট আসলেও, সাইবার অপরাধীদের টেকনিকও একই সাথে আপডেট হয়েছে। ফলে উইন্ডোজ ডিফেন্ডার এখনো অনেকাংশেই অকার্যকর। চলুন দেখে নেয়া যাক এমন কয়েকটি কারণ যা উইন্ডোজ ডিফেন্ডারকে নিয়ে এত এত অভিযোগের সৃষ্টি করছে এবং সত্যিকারের সাইবার সিকিউরিটি সফটওয়্যার ব্যবহারের গুরুত্ব বাড়িয়ে তুলছে।
পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ উইন্ডোজ ব্যবহারকারী আছে এবং প্রতিটির সাথে উইন্ডোজ ডিফেন্ডার প্রি-ইন্সটল্ড হিসেবে আসে। তাই সব ভার্সনের ডিফেন্ডারগুলোই একই পদ্ধতিতে তৈরি, একই কোডবেইজের একই জিনিস। যেহেতু প্রতিটি মেশিনে একইভাবে কাজ করে, ফলে সাইবার অপরাধীদের জন্য এমন কোন সিস্টেম ব্রিচ করা তুলনামূলক সহজ।
তাছাড়া যে দ্রুততার সাথে বিভিন্ন ভাইরাস ও ম্যালওয়্যার আপডেট হয়, বেশিরভাগ সময় উইন্ডোজ ডিফেন্ডার তার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে না। ফলে পিসি হয়ে পড়ে অরক্ষিত। অনেক ভাইরাস ও ম্যালওয়্যার ডিফেন্ডারের সিকিউরিটি ভেদ করে পিসিতে ঢুকে পড়ে। অতীতে এমন ঘটনাও ঘটেছে যেখানে ভাইরাস পিসিতে প্রবেশ করে খোদ উইন্ডোজ ডিফেন্ডারকেই ডিজেবল করে ফেলেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে!
বর্তমানে প্রতিনয়ত বাড়ছে নতুন নতুন ডিভাইস ব্যবহারের সংখ্যা। ভিন্ন ভিন্ন সেকটরের এসব ডিভাইস আবার ভিন্ন ভিন্ন ওএসে রান করে। আর বিভিন্ন ডিভাইসের মধ্যে ক্রস-প্ল্যাটফর্ম সাপোর্ট একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কেননা কোন ডিভাইসই সাইবার অপরাধীদের হাত থেকে নিরাপদ নয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, উইন্ডোজ ডিফেন্ডারে কোন ক্রস-প্লাটফর্ম সাপোর্ট নেই।
এমন হতেই পারে যে, কারো পিসি রান করছে উইন্ডোজে, মোবাইল আইওএসে (অ্যাাপল) আর ট্যাব অ্যান্ড্রয়েডে। এক্ষেত্রে উইন্ডোজ ডিফেন্ডার থেকে কোন সাপোর্ট পাওয়া যাবে না। অথচ মর্ডান সাইবারসিকিউরিটি সল্যুশন এবং অ্যান্টিভাইরাস সফটওয়্যারগুলো এক্ষেত্রে এক ধাপ এগিয়ে। প্রায় সবগুলোতেই থাকে মোবাইল সিকিউরিটি ফিচার। এর বাইরেও ওয়েব ড্যাশবোর্ড এর মাধ্যমে থাকে যে কোন জায়গা থেকে অ্যাক্সেস করার সুযোগ। আর রিভ অ্যান্টিভাইরাস টোটাল সিকিউরিটির মত অ্যাডভান্সড সাইবার সিকিউরিটি সফটওয়্যারগুলো পিসিতে কোন ভাইরাস ধরা পড়লে সেই তথ্য লাইভ নোটিফিকেশনের মাধ্যমে মোবাইলেও পাঠিয়ে দেয় সাথে সাথে, যা উইন্ডোজ ডিফেন্ডারের বেলায় চিন্তাও করা যায় না।
নতুন আপডেটে কিছুটা উন্নত হলেও উইন্ডোজ ডিফেন্ডারের পুরাতন ভার্সনগুলো সম্পূর্ণ অকার্যকর। অনেক ইউজার অভিযোগ করেছেন পুরাতন ভার্সনে তাদের পিসি র্যানসমওয়্যার সহ বিভিন্ন ম্যালওয়্যারে আক্রান্ত হয়েছে উইন্ডোজ ডিফেন্ডার অন থাকার পরেও। এমনকি মাইক্রোসফটের নিজস্ব ওয়েবসাইটের কমিনিটি পেইজেই এমন অনেক রিভিউ আছে যেখানে জেনুইন উইন্ডোজের ব্যবহারকারীরা অভিযোগ করেছেন যে তাদের পিসিতে অ্যাডওয়্যার এবং ম্যালওয়্যার অ্যাটাক রুখতে উইন্ডোজ ডিফেন্ডার সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। এছাড়া কাজের সময় ডিফেন্ডারের কাছ থেকে দরকারী সহায়তা না পাবার অভিযোগও করেছেন ব্যবহাকারীরা।
আমাদের দেশের বাস্তবতায় অনেক প্রতিষ্ঠানের পিসিতেই উইন্ডোজের অনেক পুরাতন ভার্সন ব্যবহার করা হয়, যেগুলোর হয়ত আপডেট আসাই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এসব পিসিতে কোন সাইবারসিকিউরিটি সফটওয়্যার তো নেইই, দেখা যায় যে উইন্ডোজ ডিফেন্ডারের অকার্যকর ভারসনটিই হয়ত রান করছে। ফলে এসব কম্পিউটারে সাইবার অ্যাটাকের সম্ভাবনা বেড়ে যায় বহুগুণে।
উইন্ডোজ ডিফেন্ডার ব্যবহার করার অন্যতম প্রধান যে যুক্তিটি দেয়া হয় তা হল এটি ফ্রি, কিন্তু তা কি আসলেই সত্য? চলুন দেখে নেয়া যাক।
যদিও মাইক্রোসফট তাদের বিভিন্ন ফিচার নিয়ে সর্বদা উচ্চকন্ঠ তবে এর মাঝে একটি অনুচ্চারিত “কিন্তু” রয়েছে, যা শুধুমাত্র উইন্ডোজ ব্যবহার করতে শুরু করলেই উপলব্ধি করা সম্ভব। উইন্ডোজ ডিফেন্ডার থেকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা পেতে হলে শুধুমাত্র মাইক্রোসফটের পণ্য ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক।
এর অর্থ হল, যদিও ডিফেন্ডারের জন্য আপনাকে সরাসরি কোন খরচ করতে হচ্ছে না কিন্তু সেই ডিফেন্ডার থেকে সাইবার নিরাপত্তা পেতে আপনাকে এমন সব সফটওয়্যার ব্যবহার করতে হবে যেগুলো টাকা দিয়ে কিনতে হয়! আপনাকে অরিজিনাল অফিস ৩৬৫-এর সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে, ট্রায়াল অথবা ক্র্যাক ভার্সন ব্যবহার করলে হবে না। যেখানে বেশিরভাগ মানুষই গুগল ক্রম বা মোজিলা ফায়াফক্সের মত ব্রাউজার ব্যবহার করে, ডিফেন্ডারের কিছু দরকারী ফিচার শুধুমাত্র মাইক্রোসফট এজে কাজ করবে। এমনকি বর্তমানে সর্বাধিক ব্যবহৃত মিটিং সফটওয়্যার জুম-ও উইন্ডোজ ডিফেন্ডারের সিকিউরিটির আওতায় নেই। উইন্ডোজ ডিফেন্ডার শুধুমাত্র “মাইক্রোসফট টিমস”-নামক কমিনিকেশন সফটওয়্যারের সাইবার সিকিউরিটি প্রদান করবে যা অবশ্যই মাইক্রোসফটের কাছ থেকে টাকা দিয়ে কিনে ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক।
সবধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকার পরেও দূর্ঘটনাক্রমে ডেটা লসের ঘটনা ঘটতে পারে। এজন্যই যে কোন প্রতিষ্ঠান বা ব্যবহারকারীর জন্য ডেটা ব্যাকআপ সিস্টেম সেট আপ করে রাখা জরুরি। কিন্তু উইন্ডোজ ডিফেন্ডারে নেই কোন ডেটা ব্যাক আপের সুবিধা। ফলে কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ ডেটা হয়ে পড়ে অরক্ষিত। অথচ যে কোন মর্ডান সাইবার সিকিউরিটি সফটওয়্যারে কোন না কোন ফরম্যাটে ডেটা ব্যাক আপ সুবিধা থাকবেই, যা নিশ্চিত করে ডেটার সুরক্ষা।
এর বাইরেও কিছু নিত্যব্যবহার্য কমন ফিচারও উইন্ডোজ ডিফেন্ডারে অনুপস্থিত, সেফ ব্রাউজিং যার মধ্যে অন্যতম। এছাড়া ভিপিএন, ইমেইল সিকিউরিটি, অ্যান্টি স্প্যাম, অ্যান্টি ফিশিং টেকনোলজির মত গুরুত্বপূর্ণ টেকনোলজিও ডিফেন্ডারে অনুপস্থিত।
মূলত এসকল কারণেই উইন্ডোজ ডিফেন্ডার কোন প্রতিষ্ঠানের জন্য দরকারী সাইবার সিকিউরিটি নিশ্চিত করতে পারে না। তাই সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানেরই উচিত সময় থাকতেই একটি আধুনিক সাইবার সিকিউরিটি সফটওয়্যারে বিনিয়োগ করে সর্বোচ্চ সাইবার সিকিউরিটি নিশ্চিত করা।