অনলাইনে প্রলুব্ধ করে কাউকে অন্যায় কিছুতে উৎসাহিত করা বা কারো এ ধরণের কোনো দুর্বলতা নিয়ে হেয় প্রতিপন্ন করা, ভয় দেখানো বা মানসিক নির্যাতন করা ‘সাইবার বুলিং’। শুরুতে টিনএজাররাই কেবল এ ধরণের সাইবার হয়রানির শিকার হলেও পরে দেখা যায় মধ্যবয়সীরাও প্রায়ই সাইবার বুলিং ভিক্টিম হয়ে থাকেন। নারীরা, বিশেষত শিক্ষিকাবৃন্দ বেশিরভাগ টার্গেটে পরিণত হলেও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তালিকায় আছে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীসহ ফেসবুক ব্যবহারকারী গোষ্ঠীর একটি বড় অংশ। দৈনিক প্রথম আলো প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী – বাংলাদেশের ৪৯% স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীই সাইবার বুলিং-এর নিয়মিত শিকার। এছাড়াও, ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম এক সাক্ষাৎকারে জানান – দেশের তিন-চতুর্থাংশ নারীই সাইবার নিপীড়নের শিকার। ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে এঁদের মধ্যে মাত্র ২৬% অনলাইনে হেনস্তার বিষয়টি প্রকাশ্যে এনে অভিযোগ করেন, এবং অন্যরা সামাজিকতার ভয়ে গোপন রাখেন।
সাইবার বুলিং-এর ঘটনা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘটলেও ফোনে কিংবা ইমেইলেও অনেক সময় এ ধরণের নির্যাতনের ঘটনা ঘটে থাকে। সাইবার বুলিং-এর কোনো সূত্র পাওয়া গেলে বা এ ধরণের ঘটনা একবার ঘটলে বিকৃত ও অসুস্থ মানসিকতার আরও অনেকের কাছে ভিক্টিমের খোঁজ বা যোগাযোগের তথ্য চলে যায় বলে ধীরে ধীরে এর মাত্রা বাড়তেই থাকে। সাইবার বুলিং-এর প্রভাব এত বেশি মারাত্মক যে এর ক্রমঃবর্ধমান চাপে শিশু-কিশোরদের মাঝে ডিপ্রেশন, পড়াশুনার প্রতি অনীহা, ইনসমনিয়া থেকে শুরু করে আত্মহত্যার প্রবণতা তৈরি হতে পারে। তাই, সাইবার বুলিং প্রতিরোধে জনসচেতনতা বাড়াতে সাইবার স্মাইল ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে প্রতি বছর জুন মাসের তৃতীয় শুক্রবার (সে হিসাবে এবার ১৬ জুন, ২০১৭) ‘স্টপ সাইবার বুলিং ডে’ নামে পালিত হয়ে আসছে। মূলত সাইবার বুলিং কী – সে বিষয়ে সবার ধারণা তৈরি, সন্তান ইন্টারনেটে (কম্পিউটার এবং মোবাইলে) কী করছে তা জানা ও সন্তানদের সাথে বাবা-মায়ের বন্ধুসুলভ সুসম্পর্ক তৈরিতে উৎসাহিত করা এই দিবসের উদ্দেশ্য।
অনেক সময় আবেগে অফ কিংবা অনলাইনে কারও সাথে ভুল সম্পর্কে জড়িয়ে কেউ যখন পিছপা হতে চান, তখন ভয় দেখিয়ে বা মানসিক (সম্পর্ক অনলাইন থেকে অফলাইন অবধি গড়ালে শারীরিক অত্যাচারও হতে পারে) নির্যাতন করে কোনোকিছুতে বাধ্য করার চেষ্টাই হচ্ছে সাইবার বুলিং। সম্মানের ভয়ে বা পরিবারের কথা ভেবে অনেকেই এসময় ‘চুপ’ থাকে বলে অপরাধীরা তখন আরও বেশি সুযোগ নেয়। সাধারণত অর্থ ও অন্যান্য সুবিধা আদায়ের পাশাপাশি সাইবার বুলাররা এসময় অন্যদের দিয়েও একই ভিক্টিমকে নির্যাতন করে থাকে।
যেহেতু শিশু-কিশোর ও তরুণীরা সাইবার বুলিং-এর সবচেয়ে বেশি শিকার হয়ে থাকে তাই বাবা-মাকে সবার আগে সন্তানের বন্ধু হতে হবে। সাইবার বুলিং কী, অপরিচিত বা অনলাইন বন্ধুরা কেন অনিরাপদ এবং তাদের সাথে কেন ব্যক্তিগত কিছু শেয়ার করা যাবে না – এসব সন্তানদের বুঝিয়ে বলতে হবে। সম্ভব হলে সোশ্যাল মিডিয়ায় যুক্ত থাকতে হবে সন্তানদের সাথে, এবং সর্বোপরি নজর রাখতে হবে সন্তানের অনলাইন পদচিহ্নে। সন্তান আপনার আড়ালে ইন্টারনেটে কী করছে, কোন কোন সাইট বেশি ব্রাউজ করে কিংবা সেসব সাইটে ভয়ঙ্কর কোনো ফাঁদ পাতা নেই তো – একজন সচেতন অভিভাবক হিসেবে এসব সার্বক্ষণিক লক্ষ্য রাখা আবশ্যক।
পাশাপাশি, নিজের সচেতনতায় অনলাইনে আরও যেসব আচরণবিধি মেনে চলা উচিত, তা এখানে উল্লেখ করা হলো-
সাইবার বুলিং-এর শিকার হলে কখনোই চুপ করে থাকার কথা ভাববেন না, সরাসরি আইনের সাহায্য নিন। মনে রাখবেন, চুপ করে থাকলে সমস্যা কমবে না বরং অপরাধী আরও সাহস পেয়ে যাবে। তাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং আইনগত সহযোগিতা দেয় এমন প্রতিষ্ঠানের শরণাপন্ন হোন।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬-এ ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে মিথ্যা বা অশ্লীল কিছু প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা আছে। আইন লঙ্ঘন করলে ১৪ বছর পর্যন্ত জেলও হতে পারে। হয়রানির ঘটনায় তথ্যপ্রযুক্তি আইন বা পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা হয়ে থাকে।
হয়রানির শিকার যে কেউ সরাসরি বিটিআরসিতে যোগাযোগ করতে পারেন। বিটিআরসি ফোনে ও ইমেইলে দুইভাবেই অভিযোগ গ্রহণ করে থাকে। বিটিআরসির কম্পিউটার সিকিউরিটি ইনসিডেন্স রেসপন্স টিম এ ধরণের সমস্যায় সহায়তা করে থাকে। বিটিআরসিতে হয়রানির অভিযোগ জানাতে কল করতে পারেন (০২)৭১৬২২৭৭ নম্বরে বা ইমেইল পাঠাতে পারেন contact@csirt.gov.bd ঠিকানায়। এছাড়াও, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের হটলাইন ১০৯২১ নম্বরে ফোন করলেও গোপনীয়তা রক্ষা করে এ ধরণের সমস্যার সমাধান করা হয়।